আদমজী বন্ধের ১৪ বছর, জুট মিল থেকে ইপিজেড ॥ অর্ধলক্ষ শ্রমিকের পদচারণায় কর্মমূখর

আজ ৩০ জুন বৃহস্পতিবার। এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল বন্ধের ১৪তম বছর। বন্ধের পর ইপিজেডে রূপান্তির হওয়ার পর ‘আদমজী’ জুট মিল থেকে ইপিজেডে পরিণত হয়ে তার ঐতিহ্য ছাড়িয়ে অর্থতৈকি চাকা সচল রাখতে অবদান রাখছে। আদমজী ইপিজেডে বর্তমানে অর্ধ লক্ষ শ্রমিক কাজ করছে। বন্ধের ১৪ বছরে আদমজী এলাকা শ্রমিকদের পদচারণায় কর্মমূখর হয়ে উঠেছে।
জানা যায়, চারদলীয় জোট সরকার অব্যাহত লোকসানের অজুহাতে সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী আদমজী জুট মিলটি ২০০২ সালের ৩০ জুন চিরতরে বন্ধ করে দেয়। এরপর মিলটি বেপজার কাছে হস্তান্তর করা হলে ২০০৬ সালের ৬ই মার্চ আদমজী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (আদমজী ইপিজেড) যাত্রা শুরু হয়।
ইপিজেড সূত্রমতে, প্রায় ২৯১.১২ একর জমির ওপর আদমজী ইপিজেড (এইপিজেড) স্থাপিত। এতে মোট প্লটের সংখ্যা ২২৯টি। ইতিমধ্যে ৬৫টি দেশী-বিদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে দেশী মালিকানাধীন ২০টি, বিদেশী মালিকানাধীন ২৬টি এবং যৌথ মালিকানাধীন ১৯টি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। ১২টি প্রতিষ্ঠান নির্মাণাধীন রয়েছে। বর্তমানে ৫২টি কারখানা চালু রয়েছে। প্রতিটি প্লটের আয়তন ২ হাজার বর্গ মিটার। কোন কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান ১০ এর অধিকও প্লট বরাদ্দ নিয়ে কারখানা করেছেন। এসব কারখানায় গার্মেন্ট, জিপার, কার্টন, হ্যাঙ্গার, লেভেল, ট্যাগ, জুতা, সোয়েটার, টেক্সটাইল, মুজা, জুয়েলারি, পলি ও ডায়িংসহ ইত্যাদি পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। যা ১০০ ভাগ রপ্তানিযোগ্য। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি  শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছে। এর মধ্যে বিদেশী কর্মকর্তা-কর্মচারীও রয়েছেন। এ পর্যন্ত বিনিয়োগ করা হয়েছে ৩৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডালার। হংকং, কানাডা, জাপান, রোমানিয়া, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, ইউইএ, আমেরিকা, থ্যাইল্যান্ড, ভারত, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ইউক্রেন, দক্ষিণ কোরিয়া, কুয়েত, পর্তুগাল, চীন ও মরিশাসসহ বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ এই ইপিজেডে বিনিয়োগ করেছে। চলতি বছরে আদমজী ইপিজেড থেকে প্রায় ৪১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৬৮৫.২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়।
পেছনের কথা: তৎকালীন পাকিস্তানের ২২ পরিবারের অন্যতম ধনাঢ্য আদমজী পরিবারের তিন ভাই ওয়াহেদ আদমজী ওরফে দাউদ আদমজী, জাকারিয়া আদমজী ও গুল মোহাম্মদ যৌথভাবে ১৯৫০ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ২৯৪ দশমিক ৮৮ একর জমি নিয়ে আদমজী জুট মিলস নির্মাণ করেন। ১৯৫১ সালের ১২ই ডিসেম্বর ১৭০০ হেসিয়ান ও ১০০০ সেকিং লুম দিয়ে এই মিলের উৎপাদন শুরু হয়। তখন প্রায় ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত আদমজী জুটমিলে প্রতিদিন গড়ে ২৮৮ টন পাটের চট উৎপাদন করা হতো। তখন মিলে ৩ হাজার ৩০০টি তাঁতকল বসানো হয়। ওই সময় মিলের উৎপাদন থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। আদমজীর চটের ব্যাগ ও বস্তার একটি অংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হতো। ৪ নং মিলে তৈরি উন্নতমানের ব্রডলুম, জিও নামে পাটজাত পণ্য পুরোটাই বিদেশে রপ্তানি হতো। ৫নং মিলে (এবিসি) তৈরি হতো লেমিনেটেড পলি ব্যাগ। ৬নং মিলটি ছিল ওয়ার্কশপ। শুরুতে প্রায় ১০০ টন পাটজাত পণ্য উৎপাদন হলেও ধীরে ধীরে তা বেড়ে আড়াই শ’ টনে উন্নীত হয়। ওই সময় মিলটিতে ২৪ হাজার ৯১৬ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক কাজ করতেন।
মিল কম্পাউন্ডের মধ্যে ছিল আদমজী হাইস্কুল, আদমজী গার্লস হাইস্কুল, আদমজী শ্রমিক কল্যাণ হাইস্কুল এবং আদমজী ইসলামীয়া সিনিয়র মাদরাসা। এ ছাড়াও খাজা মইনুদ্দিন হাফেজি মাদরাসা, হিলফুল ফুজল কওমি মাদরাসা, আশ্রাফুল উলুম নূরানী মক্তব, মুক্তিযোদ্ধা প্রাইমারি স্কুল এবং পথকলি শিশু কল্যাণ প্রাইমারি স্কুল ছিল। এর মধ্যে চালু রয়েছে শুধু পথকলি শিশু কল্যাণ প্রাইমারি স্কুলটি। আর ভবন হিসেবে টিকে আছে আদমজী হাইস্কুল ভবনটি। যা এখন ব্যবহার হচ্ছে র‌্যাব’র ক্যাম্প হিসেবে। এ ছাড়া পুরানো আর কোন প্রতিষ্ঠানেরই অস্তিত্ব নেই।
১৯৫১ সালে আদমজী জুট মিল স্থাপিত হয় এবং ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আদমজী হাইস্কুল। শিক্ষকদের দাবি ছিল, আদমজী শুধু চটের বস্তা তৈরিরই জায়গা ছিল না, এখান থেকে তৈরি হয়েছে মেধাবী শিক্ষার্থীও। ১৯৮০ সালে আদমজী হাইস্কুলের এক ছাত্র উচ্চ-মাধ্যমিকে মানবিক বিভাগে ঢাকা বোর্ডে প্রথম স্থান দখল করে। ১৯৯৬ সালে এসএসসি’তে মানবিক বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করে আরেক ছাত্র এবং ২০০০ সালে একই বিভাগের এক শিক্ষার্থী অর্জন করেন তৃতীয় স্থান। কিন্তু মিল বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে এতসব অর্জনেরও ইতিহাস।

About Unknown

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments :

Post a Comment